পরিবারে নতুন অতিথি এসেছে। সবাই ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে দারুণ খুশি। এরই মধ্যে একজন আত্মীয় বাচ্চার মা’কে বলে ফেললেন, “এবার নিজের ওজন কমানোর চেষ্টা করো, তুমি তো অনেক মোটা হয়ে গেছো।” এ কথায় বাচ্চাটির মা বেশ মন খারাপ করলেও মুখে কিছু বললেননা। কারণ নিজের আত্মীয়দের কিছু বলা যায় নাকি?
ঘটনাটি হয়তো আপনাদের পরিচিত লাগছে। আপনারা অনেকে হয়তো নিজেরাও জীবনের কোনো না পর্যায়ে এমন ঘটনার স্বীকার হয়েছেন। এই ঘটনাটিকে ইংরেজিতে বডি শেমিং বলা হয়। সহজ ভাষায় বডি শেমিং হলো কাউকে তার শারীরিক কোনো বৈশিষ্ট্য নিয়ে অপমান বা উপহাস করা। আমাদের সমাজে নারীরা প্রতিনিয়তই বিভিন্নভাবে বডি শেমিংয়ের স্বীকার হয়ে চলেছেন। তারা তাদের শারীরিক গঠন, উচ্চতা, ওজন এমনকি গায়ের রং নিয়েও অপমান ও ঠাট্টার স্বীকার হন।
কারা নারীদের বডিশেমিং করেন?
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো কাছের মানুষরাই নারীদের সবচাইতে বেশি বডিশেমিং করে থাকেন। এছাড়াও অফিসের কলিগ কিংবা বন্ধুবান্ধবরাও বডি শেমিং করতে পিছপা হননা। এর ফলস্বরূপ কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান, অফিসের গেট টুগেদার, দাওয়াত, বিয়ে কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময়ে নারীদের শুনতে হয়, ” তুমি এত চিকন, দেখতে তো পাটকাঠির মতো লাগে”, “খেতে খেতে তো হাতির বাচ্চা হয়ে গেছো, একটু খাওয়া কমাও”, ” তোমাকে দেখলে লিলিপুটের কথা মনে পড়ে” – এমন আরো নানারকম কথা।
যারা বডিশেমিং করেন, তারা মূলত ঠাট্টা বা মজা করার ছলেই এটি করে থাকেন। অথবা তাদের ভাব এমন থাকে, যে তারা আমাদের ভালোর জন্যেই এভাবে বলছেন। অথচ তাদের কথা যে আমাদের মধ্যে নিজেদের নিয়ে ইনসিকিউরিটি তৈরি করছে, সেটি তারা হয়তো বুঝেও বোঝেন না। কখনো যদি তাদেরকে উত্তরে কঠিনভাবে কিছু বলা হয়, বা বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে তাদের বলার ধরণ আমাদের কষ্ট দিচ্ছে, তাহলে তারা উলটো রেগে যান। এ থেকেই বোঝা যায়, বডিশেমিংয়ের কালচার আমাদের সমাজে পাকাপোক্তভাবেই গেঁড়ে বসেছে।
বডিশেমিংয়ের ইমপ্যাক্ট কেমন হয়?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বডিশেমিংয়ের স্বীকার হলে মানুষ শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে তাদের মনে। একজন নারীর ক্ষেত্রে প্রথমত তার নিজেকে নিয়ে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করতে থাকে। যেমন ধরুন, কোনো নারীকে তার অতিরিক্ত ওজনের জন্য বডিশেমিং করা হলে তিনি ভাবতে থাকেন তার অতিরিক্ত ওজনের কারণে তাকে সমাজের কেউ আর অ্যাকসেপ্ট করবেনা, কারণ কম ওজনের মানুষদেরই সবাই সুন্দর ও ফিট হিসেবে অ্যাপ্রিশিয়েট করে।
এখান থেকেই তার মধ্যে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স ক্রিয়েট হয়। যার ফলে তিনি নিজেকে আর ভালোবাসতে পারেননা। তার আত্মবিশ্বাস কমে যেতে থাকে। তিনি সবসময় লো ফিল করতে থাকেন এবং সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। একসময় ডিপ্রেশনও তৈরি হয়। অনেকে আবার সেল্ফ হার্মও করেন। এগুলোর পাশাপাশি অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দেয়।
বডিশেমিংয়ের সবচেয়ে ভয়াবহ ইমপ্যাক্ট হলো এটির স্বীকার হলে নারীরা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের বদলে ফেলার চেষ্টা করেন। যেমনঃ যিনি চিকন, তিনি হয়তো মোটা হওয়ার ওষুধ খুঁজতে থাকেন। আবার যিনি একটু শ্যামলা, তিনি হয়তো মুখের রং ফর্সা করতে পারে এমন ক্রিম খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা হয়ে যান। এতে করে দিনশেষে তাদেরই ক্ষতি হয়।
কিভাবে বডিশেমিং বন্ধ করা যায়?
বডিশেমিং এমন একটি সমস্যা যেটি কোনো আইনকানুনের মাধ্যমে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই এটি বন্ধ করার জন্য নিজেদের মেন্টালিটিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যদিও এটি মোটেও একরাতের কাজ নয়। তবে অসম্ভব কিছুও নয়!
প্রথমত যারা বডিশেমিং করে তাদেরকে ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করুন যে প্রতিটি মানুষই পারফেক্ট। একজন মানুষ দেখতে কেমন সেটির ওপরে তার কোনো হাত নেই। তাই তাদেরকে উপহাস করার কোনো মানেই হয়না। বডিশেমিংয়ের বাজে ইমপ্যাক্টগুলোও তাদের বোঝান৷ এভাবে তাদের বুঝিয়ে বললে যারা বুঝতে পারবেন তারা আর কাউকে বডিশেমিং করবেননা। আপনি সবাইকে হয়তো বোঝাতে পারবেননা, কিন্তু আপনার মাধ্যমে যদি একজনও বডিশেমিং করা বন্ধ করেন, তাহলে সেটিও কিন্তু আপনার দারুণ প্রাপ্তি।
এর পাশাপাশি বডিশেমিং বন্ধ করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রেও এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরই। সোশ্যাল মিডিয়া হতে পারে বডি শেমিং নিয়ে আওয়াজ তোলার পারফেক্ট একটি প্ল্যাটফর্ম। এছাড়াও যারা মিডিয়ার সাথে আছেন, তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বডিশেমিং বন্ধ করার কনসেপ্ট প্রোমোট করতে পারেন। এভাবে যদি সবাই মিলে চেষ্টা হয়, তাহলে খুব শীঘ্রই নারীদের আর বডিশেমিংয়ের স্বীকার হতে হবেনা।
লিখেছেনঃ সুমাইয়া রহমান দোলা