ওজন যত দ্রুত বাড়ে, তত দ্রুত কি কমানো যায়? একটু কঠিনই বটে, তাই না? আর এ কারণে আমাদের মনটাও খারাপ হয়ে যায়। দেখা যায় হুটহাট খাবার খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছি, ওজন না কমায় ডিপ্রেশনে পড়ে আবারও বেশি বেশি খেয়ে ফেলছি। সেই সাথে প্রসেসড ফুড, জাঙ্ক ফুড এগুলো খাওয়া তো আছেই। সবকিছু মিলিয়েই বাড়ন্ত ওজন নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই সবাই। কিন্তু শুধু চিন্তা করলেই তো আর ওজন কমবে না। এজন্য মেনে চলতে হবে সঠিক ডায়েট ও লাইফস্টাইল। ওজন কমাতে চাইলে কী কী করণীয় রয়েছে সে সম্পর্কেই আজ জানাবো আপনাদের।
ওজন কমাতে করণীয়
১) ডায়েটে প্রোটিন অ্যাড করুন
ওজন কমাতে চাইলে পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে, যে তালিকায় প্রথমেই আসে প্রোটিন। হাই প্রোটিন ডায়েট মেটাবলিজম বুস্ট করে। সেই সাথে দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে এবং ক্ষুধার প্রবণতা কমায়। এই প্রোটিন জাতীয় খাবারের তালিকায় শুরুতেই আছে ডিম। ব্রেকফাস্টে ডিম অবশ্যই রাখতে হবে। ডিম সিদ্ধ বা পোচ যেভাবে আপনার ভালো লাগে খেতে পারেন। সেই সাথে ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, বাদাম সবই রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়।
২) পর্যাপ্ত পানি পান করুন
সুস্থ থাকতে হলে পানি পানের গুরুত্ব অপরিসীম। আর ওজন কমাতেও সাহায্য করে পানি। পরিমিত পানি পানে শরীরের হাইড্রেশন বজায় রাখা সম্ভব। পানিতে কোনো ক্যালরি নেই, তবে সফট ড্রিংকসে প্রচুর চিনি ও ক্যালরি থাকে। পানি আমাদের শরীর থেকে ক্ষতিকারক টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। খাবার খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিতে পারেন। এতে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমবে। ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
৩) চিনি পরিহার করুন
ওজন কমাতে চাচ্ছেন কিন্তু চিনিযুক্ত খাবার বাদ দিতে পারছেন না? এমন হলে ওজন কমানো বেশ কঠিন হয়ে যাবে। ওজন কমানোর জন্য খাদ্যতালিকা থেকে চিনি বাদ দেয়া আবশ্যক। ১ চা চামচ চিনিতে ১৬ শতাংশ ক্যালরি থাকে, যা ওজন কমতে বাঁধা দেয়। অতিরিক্ত চিনি খেলে হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। তাই চিনি দিয়ে বানানো চা বা মিষ্টিযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৪) রাতে জলদি খান
আমরা অনেকেই রাতের খাবার দেরি করে খাই এবং জলদি শুয়ে পড়ি। যার কারণে ক্যালরি বার্ন হয় না এবং ওজনও বেড়ে যায়। তাই চেষ্টা করুন রাতের খাবার দ্রুত খেয়ে নিতে। যদি রাত ৮টার মধ্যে খেয়ে নিতে পারেন তাহলে ঘুমানোর আগে খাবার হজম হওয়ার সময় পাবে। এতে শরীরে ফ্যাট জমবে না।
৫) ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করতে পারেন
বর্তমান সময়ে এই ফাস্টিং এর কথা বেশ শোনা যাচ্ছে। কারণ এর উপকারিতা অনেকেই পেয়েছেন। এই ফাস্টিং এ খাবার কতটুকু খাচ্ছেন সেটা নয়, বরং কোন সময়ে খাচ্ছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি ইন্টারমিটেন্ট পদ্ধতি হলো ১৬ঃ৮ এবং ৫ঃ২। ১৬ঃ৮ মানে হলো দিনের মধ্যে যে কোনো সময় সুবিধা অনুযায়ী আপনি ৮ ঘন্টা খাবেন আর বাকি ১৬ ঘন্টা কোনো রকম ক্যালরি গ্রহণ করতে পারবেন না। একদম না খেয়ে থাকা নয় অবশ্য। এ সময়ের ভেতর আপনি চাইলে পানি, শসা বা কম ক্যালরিযুক্ত ফল খেতে পারেন। ৫ঃ২ হলো সপ্তাহে ৫ দিন স্বাভাবিক খাবার খাওয়া এবং ২ দিন উপবাস থাকা। এই দুটোর যে কোনো একটি করে আপনি ওজন দ্রুত কমাতে পারবেন। তবে অনেকেরই এই ফাস্টিং এর কারণে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। তাই শরীর এই ফাস্টিং নিতে পারবে কিনা তা জেনেবুঝে তবেই সিদ্ধান্ত নিন।
৬) মাইন্ডফুলি খাবার খান
মাইন্ডফুল ইটিং মানে কী? এর মানে হচ্ছে আপনি যে খাবার খাচ্ছেন তাতে শরীর সাড়া দিচ্ছে এবং শরীরও বুঝতে পারছে যে আপনি অতিরিক্ত খাচ্ছেন না। কীভাবে এটি সম্ভব?
ধীরে ধীরে খাওয়া – দ্রুত খাবার খাওয়ার সমস্যা হচ্ছে মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না আপনার কতটুকু ভরপেট খেয়েছেন। ধীরে ধীরে খেলে পেট থেকে মস্তিষ্কে সিগন্যাল যাবে যে, খাবারে আপনার পেট ভরেছে, আর এতে আপনার ক্ষুধার সাথে পেট ভরার সম্পর্ক থাকবে। এতে আপনিও কম খাবেন।
খাবারের টেক্সচার বোঝা – তাড়াহুড়ো করে খাবার খেলে কোন খাবারের কী রঙ, স্বাদ বোঝা কঠিন হয়ে যায়। তাই, খাবারের রঙ ঠিক রেখে যেমন রান্না করতে হবে, তেমনই ধীরে খাওয়া প্র্যাকটিস করতে হবে।
মনোযোগ দেয়া – খাবার খাওয়ার সময় টিভি দেখা, মোবাইল চালানো, মুভি দেখা আমাদের অনেকেরই অভ্যাস। এই অভ্যাস চালু থাকলে খাবার খাওয়ার পরিমাণ কখন বেড়ে যাবে বুঝতেই পারবেন না। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই অভ্যাস ত্যাগ করা জরুরি।
৭) পর্যাপ্ত ঘুমান
আপনি কি জানেন ঘুম ভালো না হলেও ওজন বাড়ে? যদি রাতের ঘুম ভালো না হয়, তাহলে সারাদিন ঝিমুনিভাব থাকে, হজমে সমস্যা হয় আর ক্ষুধা বাড়ে। তাই রাতে অন্তত ৬-৭ ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
৮) ব্যায়াম করুন
ওজন কমাতে আরও একটি কার্যকর উপায় হচ্ছে ব্যায়াম। শরীর ফিট রাখার জন্য, সুস্থ থাকার জন্য ব্যায়াম খুবই কার্যকরী। এজন্য প্রতিদিন সকালে বা সন্ধ্যায় ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার প্র্যাকটিস করুন। সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানোও খুব ভালো এক্সারসাইজ। জিম বা পার্কে যদি যাওয়ার সুযোগ না থাকে, তাহলে ঘরেই ইয়োগা করতে পারেন। ইয়োগা কিন্তু শরীর ও মন উভয়ই ভালো রাখে। মেডিটেশন, ডিপ ব্রিদিংও করতে পারেন।
৯) ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি খাবেন
ফাইবারযুক্ত খাবারের সুবিধা হচ্ছে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকে। এতে বাড়তি খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে না। তাই ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ জাতীয় খাবারে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে। সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, শস্যদানা, ওটস, বাদাম, ছোলা ইত্যাদি খাবার নিয়মিত খেতে পারেন। সব ধরনের প্রসেসড ফুড খাবার তালিকা থেকে বাদ দিন। কারণ এগুলোতে থাকা বাড়তি চিনি, লবণ, ক্যালরি শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়, দানা বাঁধে নানা অসুখ।
১০) স্ট্রেস কমান
আমাদের শরীরে থাকা স্ট্রেস হরমোনের নাম কর্টিসল। এই কর্টিসল বেশি নিঃসৃত হলে ব্লাড গ্লুকোজের লেভেল বেড়ে যায়, যা ব্লাড ইনসুলিন লেভেলে পরিবর্তন করে। স্ট্রেস যত বাড়ে, তত এই লেভেলও বাড়তে থাকে। যার কারণে মিষ্টি বা লবণাক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। আর এতে ওজন দ্রুত বাড়ে। তাই ওজন কমাতে স্ট্রেস লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। স্ট্রেস কমাতে যা যা করতে পারেন-
- কাজের মাঝে ব্রেক নেয়া
- প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো
- বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া
- ব্যায়াম করা বা হাঁটা
- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া
- ধূমপান না করা
- পর্যাপ্ত ঘুমানো
- মেডিটেশন করা
- ব্রিদিং এক্সারসাইজ করা
১১) গ্রিন টি পান করুন
গ্রিন টি তে আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। ফ্যাট বার্নিং ও ওয়েট লসের মতো বিভিন্ন উপকারিতা আছে এতে। গ্রিন টি পান করলে ১৭% এর মতো ফ্যাট বার্ন হয়, বিশেষ করে হার্মফুল বেলি ফ্যাট। তাই ওজন কমানোর জন্য যে যে রুটিন ফলো করছেন, তার সাথে গ্রিন টি পান করুন।
ওজন কমাতে যেয়ে আমরা অনেকেই অনেক ধরনের হার্শ অ্যাকটিভিটিজ করে ফেলি। যেমন- জিমে অতিরিক্ত সময় দেই, চাহিদার অতিরিক্ত প্রোটিনযুক্ত খাবার খেয়ে ফেলি, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকি। এসব কাজ করলে কোনো উপকার তো হবেই না, বরং শরীর আরও খারাপ হবে। ওজন কমানোর জন্য সঠিক ডায়েট ও লাইফস্টাইল মেনে চলা জরুরি। কোন খাবারে কী পুষ্টি রয়েছে, কতটুকু হাঁটলে বা ব্যায়াম করলে আপনার শরীর খারাপ হবে না, স্ট্রেস কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখলে আপনি ভালো থাকবেন – এসব আপনাকেই বুঝতে হবে। নিয়ম মেনে ওজন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবি – সাটারস্টক