আপনার কি কখনো এমন হয়েছে যে, দিনে বা রাতে হুটহাট কোনো খাবারের ক্রেভিং হচ্ছে? মনে হচ্ছে যেন, ঠিক তখনই সেই খাবারটি না খেলে আপনার চলছেই না? যেভাবেই হোক, সেই খাবারটি আপনার তখন লাগবেই! এই ফুড ক্রেভিং হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে প্রসেসড ফুড, সল্টি, সুইট, ক্রাঞ্চি স্ন্যাকস, ডোনাট, কুকিজ ইত্যাদি খাওয়ার লোভ যেন একেবারেই সামলানো যায় না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে শরীর খারাপ হতেও সময় লাগবে না। কিন্তু এই ফুড ক্রেভিং কেন হয় আর কীভাবেই বা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? আজকের আর্টিকেলে এ বিষয়েই জানাবো বিস্তারিত।
ক্ষুধা ও ফুড ক্রেভিং এর মধ্যে পার্থক্য কী?
ক্ষুধা লাগলে আমরা যে খাবার খাই সেটি আর ফুড ক্রেভিং কি একই? উত্তর হচ্ছে, না। দুটো দুই ধরনের। আমাদের শরীরের এনার্জি ও নিউট্রিয়েন্ট লেভেল মেইনটেইন করার জন্য যে খাবারের প্রয়োজন সেটির জানান দেয় ক্ষুধা। এক কথায়, শরীর ও মস্তিষ্ক ভালো রাখার জন্য যে স্বাস্থ্যকর ও প্রয়োজনীয় খাবারগুলো খেতে হবে সেটি বোঝা যায় ক্ষুধার মাধ্যমে। অন্যদিকে ক্রেভিং হয় যদি হুটহাট কোনো খাবার খেতে ইচ্ছা করে। ক্রেভিং এর জন্য যে ক্ষুধা লাগতেই হবে সেটা জরুরি নয়। এটা নির্দিষ্ট কিছু খাবারের জন্য হতে পারে। বিশেষ করে চর্বিযুক্ত, লবণাক্ত বা মিষ্টি জাতীয় খাবারের জন্য ক্রেভিং বেশি হয়।
ফুড ক্রেভিং কেন হয়?
আমাদের যখন কোনো খাবারের ক্রেভিং হয় এবং সেই খাবারটি খাওয়ার পর আমাদের মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন রিলিজ হয়। এতে প্রশান্তি মেলে। কিন্তু ঠিক কী কারণে ক্রেভিং হয়? এটা একেকজন ব্যক্তির জন্য একেকভাবে কাজ করে। কিছু কারণ চলুন জেনে নেয়া যাক।
১) বাহ্যিক সংকেত পেলে – আপনি হয়ত পছন্দের কোনো মুভি বা সিরিজ দেখতে বসেছেন। হাতে নিয়ে বসেছেন এক বাটি আইসক্রিম। যতক্ষণ টিভি দেখছেন, ততক্ষণ একটু পরপর আইসক্রিম খেয়েই যাচ্ছেন। এই যে দেখে দেখে খাবার খাওয়ার ক্রেভিং এটি হয় বাহ্যিক সংকেত পেলে। অর্থাৎ একটানা কোনোকিছু দেখার সময় খাবারের ক্রেভিং হয়। সেটা হতে পারে চিপস, আইসক্রিম, পিজ্জা, চকলেট, পপকর্ন এমন যে কোনো খাবার।
২) অভ্যন্তরীণ সংকেত পেলে – আপনি যদি কোনো কারণে ডিপ্রেশনে থাকেন, মন খারাপ থাকে, তাহলে খাবার খাওয়ার ক্রেভিং বাড়বে।
৩) দিনভর খাবার থেকে দূরে থাকলে – আপনাকে ডায়েট করতে হচ্ছে বা খাবারের জন্য রেস্ট্রিকশন দেয়া আছে, সেটি ফলোও করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় সারাদিন পর রাতে হয়ত আপনার মনে হতে পারে, ‘সারাদিন আমি তেমন কিছুই খাইনি। এখন রাতে ইচ্ছামতো খেলে কিচ্ছু হবে না!’ এই পরিস্থিতিতে পড়লেও ফুড ক্রেভিং হতে থাকে।
৪) ঘুম কম হলে – যদি রাতে ঘুম কম হয়, তাহলে নানা ধরনের খাবারের ক্রেভিং হতে পারে রাতে। আর রাত যত গভীর হয়, এই ক্রেভিং তত বাড়ে।
৫) এনভায়রনমেন্টাল ট্রিগার হলে – ধরুন, আপনি কোনো বেকিং ফ্যাক্টরি বা হোটেলের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে সদ্য তৈরি হওয়া বেকিং আইটেম বা কোনো খাবারের ঘ্রাণ আপনি পেলেন। সাথে সাথেই আপনার মনে হলো এই খাবারটি আপনার তখনই খেতে হবে। এমন ক্রেভিং হলে কোনোভাবেই নিজেকে আটকে রাখা যায় না। সাথে সাথে সেই খাবারটি খেতে না পারলে অস্থির লাগে। এটিকে বলে এনভায়রনমেন্টাল ট্রিগার।
৬) হরমোনাল ফ্লাকচুয়েশন হলে – মেয়েরা যখন মেন্সট্রুয়াল সাইকেলের মধ্য দিয়ে যায় তখন অথবা প্রেগন্যান্ট অবস্থায় নানা ধরনের খাবারের ক্রেভিং হতে পারে। তখন তাদের ব্যথা, স্ট্রেস কমানোর জন্য কমফোর্ট ফুড খেতেই হয়।
ক্রেভিং কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
সুস্থ থাকার জন্য ফুড ক্রেভিং যেভাবেই হোক নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। যেহেতু ক্ষুধা থেকে এর ধরন কিছুটা ভিন্ন, তাই ইচ্ছে হলেই খেতে হবে তা জরুরি নয়। কীভাবে ক্রেভিং নিয়ন্ত্রণ করা যায় চলুন জেনে নেয়া যাক।
১) পানি পান করুন
আপনার ক্ষুধা লেগেছে নাকি ক্রেভিং হচ্ছে সেটা অনেক সময় বোঝা যায় পিপাসার মাধ্যমে। যদি আপনার হুট করে কোনো খাবার খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হয়, তখন এক গ্লাস পানি পান করুন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। যদি বুঝতে পারেন যে ক্রেভিং ধীরে ধীরে কমে এসেছে, তখন বুঝতে হবে আপনি আসলে পিপাসার্ত ছিলেন। তাছাড়া পর্যাপ্ত পানি পান করার কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতাও আছে। ক্ষুধা কমিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে পানি।
২) প্রোটিনযুক্ত খাবার খান
পর্যাপ্ত প্রোটিন খেলে ক্ষুধা কমে এবং বাড়তি খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে। তাছাড়া দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে বলে ক্রেভিং কম হয়। গবেষণামতে, ২৫% প্রোটিন গ্রহণ করলে ৬০% ক্রেভিং এর চান্স কমে। সেই সাথে রাতে স্ন্যাকস খাওয়ার আগ্রহ কমে ৫০%।
৩) ক্রেভিং থেকে নিজেকে দূরে রাখুন
যখনই বুঝতে পারবেন কোনো খাবারের জন্য ক্রেভিং হচ্ছে, তখনই মনকে ডাইভার্ট করে ফেলুন। হাঁটাহাঁটি করুন, শাওয়ার নিন, ঘর গোছান – এক কথায় যে কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে যান। যে কোনো পরিবর্তনে মনোযোগ দিলে ক্রেভিং কমে যায়। অনেক সময় চুইংগাম চিবালেও ক্রেভিং কম হয়।
৪) খাবারের পরিকল্পনা করুন
যদি সম্ভব হয়, তাহলে পরের সপ্তাহের জন্য খাবারের পরিকল্পনা আগের সপ্তাহেই করে রাখুন। কী কী খাবেন, কোন বেলায় খাবেন সেটার একটা পরিকল্পনা থাকলে আলাদা করে খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। পরিকল্পনা না থাকলে, হুটহাট ক্রেভিং হতে পারে, তখন অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৫) অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগাবেন না
আমাদের ক্রেভিং হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ক্ষুধা। তাই অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগিয়ে কখনো কিছু খাবেন না। নিয়মিত খাবার খান এবং হাতের কাছে সবসময় হেলদি স্ন্যাকস রাখুন। আগে থেকে খাবার প্রস্তুত করা থাকলে দীর্ঘ সময় না খেয়েও থাকতে হবে না, আর ক্রেভিংও হবে না।
৬) স্ট্রেস কমান
স্ট্রেসের কারণে ফুড ক্রেভিং বাড়ে এবং খাওয়ার আচরণে বদল আসে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়। স্ট্রেসে থাকা নারীরা অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার খান এবং তাদের ক্রেভিং বেশি হয়। তাছাড়া স্ট্রেসের কারণে কর্টিসল হরমোন বেশি নিঃসৃত হয়, যার কারণে ওজন বেড়ে যায়। তাই এক্সারসাইজ, মেডিটেশনের মাধ্যমে স্ট্রেস কমানোর চেষ্টা করুন।
৭) পর্যাপ্ত ঘুমান
ঘুম যদি কম হয় তাহলে ক্ষুধা লাগার যে স্বাভাবিক প্রসেস সেটা বাঁধাগ্রস্ত হয় কারণ অন্যান্য খাবারের ক্রেভিং বেশি হয়। যাদের ঘুম কম হয়, তাদের মধ্যে ওবেসিটি হওয়ার চান্সও বেশি। তাই ক্রেভিং কমানোর জন্য ঘুম পর্যাপ্ত হওয়া জরুরি।
৮) পরিশ্রম করুন
শারীরিকভাবে পরিশ্রম করলেও কার্ব ফুডের ক্রেভিং কমানো সম্ভব। তাই নিয়মিত এক্সারসাইজ করা উচিত। এর মানে এই নয় যে আপনাকে ঘন্টার পর ঘন্টা জিমে কাটাতে হবে। আপনাকে মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে হবে। এটা হতে পারে সাঁতার কাটা, নাচ প্র্যাকটিস করা, পার্কে হাঁটা। এক কথায়, শারীরিক যে কোনো কসরত আপনার হুটহাট ফুড ক্রেভিং কে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
৯) নানা ধরনের খাবার খান
একেক খাবারের একেক ধরনের ভিটামিন ও নিউট্রিয়েন্ট রয়েছে। নির্দিষ্ট একটি খাবার থেকে শরীর পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না। তাই আপনার ডায়েট এমন হতে হবে যেন তাতে নানা স্বাদের ও গুণের খাবার থাকে এবং প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পুষ্টি আপনি পান। মাঝে মাঝে ফুড ক্রেভিং এর মাধ্যমে বোঝা যায় আমাদের শরীরে কোনো উপাদানের ঘাটতি রয়েছে কিনা। যেমন- আপনার যদি মিষ্টির ক্রেভিং হয়, তাহলে বুঝতে হবে আপনার ক্রোমিয়ামের ঘাটতি রয়েছে। আর এই মিনারেল কয়েক ধরনের ফলে পাওয়া যায়। তাহলে খাদ্যতালিকায় সেই ফল যুক্ত করতে হবে। ঠিক এভাবেই খাবার বুঝে খেতে হবে যেন শরীরে কোনো মিনারেলের ঘাটতি না হয়।
সঠিক লাইফস্টাইল মেনে না চলায় অনেক সময় ফুড ক্রেভিং বেশি হতে পারে। যার কারণে ওজন বেড়ে যেতে পারে, দেখা দিতে পারে ওবেসিটি। তাই ফুড ক্রেভিং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন সেগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন আজ থেকেই। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবি – সাটারস্টক