শিলাবৃষ্টি কেন হয় এবং এ সময় করণীয় কী?

Hail 1

ছেলেবেলায় শিলাবৃষ্টি হলেই ঘর থেকে বের হয়ে শিল কুড়ানোর স্মৃতি আমাদের অনেকেরই আছে। বৃষ্টির সাথে সাথে ছোট ছোট শিলগুলো যখন টিনের চালে ঝমঝমিয়ে পড়ত, ঘর থেকে বের না হয়ে যেন ভালোই লাগতো না, তাই না? তবে এই স্মৃতি আমাদের জন্য মধুর হলেও, কৃষকদের জন্য মোটেও আনন্দের নয়। কখনো কখনো এই বৃষ্টি অনেকের জন্য প্রাণঘাতীও হতে পারে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে শিলার আকার আগের চেয়ে বেশ বড়। কিন্তু কেন? চলুন আজ জেনে নেই শিলাবৃষ্টি কেন হয় এবং কেন এর আকার ছোট বড় হয় সে সম্পর্কে।

শিলাবৃষ্টি কেন হয়?

আমাদের দেশে শিলাবৃষ্টি নতুন নয়। সাধারণত বৈশাখ মাসের আগে ও পরে এই বৃষ্টি হতে দেখা যায়। তবে আগের চেয়ে এখন এই বৃষ্টির পরিমাণ বেশি, দীর্ঘ সময় ধরে হচ্ছে এবং এর আকারও বড় হয়েছে। কিন্তু এই বৃষ্টি কেন হয়?

আবহাওয়ার ধর্ম হচ্ছে, উষ্ণ বায়ু উপরের দিকে উঠবে, শীতল বায়ু নিচের দিকে নামবে। এর মধ্যে যদি শীতল পানির উৎস পাওয়া যায়, তখন মেঘে বরফ জমতে থাকে। এক পর্যায়ে এই বরফ বেশি ভারী হয়ে গেলে বাতাস আর সেটা বইতে পারে না, বজ্রমেঘের সাথে সেই বরফ ঝরে পড়ে শিলাবৃষ্টি হয়ে।

ব্যাপারটি আরও একটু ব্যাখ্যা করে বলি।

বজ্রমেঘ

কোনো জায়গার আবহাওয়া হঠাৎ করে বেশি উত্তপ্ত হয়ে গেলে সেখানকার বাতাস হালকা হয়ে দ্রুত উপরের দিকে উঠে যায়। একে বলে বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী চাপ। এই বাতাস যখন ঊর্ধাকাশের ঠান্ডা আবহাওয়ার সংস্পর্শে আসে তখন ঠান্ডা হয়ে ঝোড়ো মেঘে পরিণত হয়। তখন ঝড় শুরু হয়। ঝড় হওয়ার এক পর্যায়ে ঊর্ধাকাশে বাতাসের জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে প্রথমে পালকের মতো হালকা তুষার এবং কিছু সময় পরে ঘন পানির বিন্দুতে পরিণত হয়, যা বৃষ্টিধারায় নেমে আসে।

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ার সময় প্রায়ই মাঝপথে বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী চাপের মধ্যে পড়ে। এর ফলে ফোঁটাগুলো নিচে নামতে নামতে কিছু অংশ আবারও উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং ঠান্ডা হয়ে যায়। ঘনীভূত এই পানির ফোঁটাগুলো আরও ভারী হয়ে নিচের দিকে নেমে আসে এবং আগের মতো গরম বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী চাপে পড়ে তার কিছু অংশ আবারও উপরের দিকে উঠে যায়।

এরকম কয়েকবার ওঠানামা করতে করতে পানির ফোঁটাগুলোর কিছু অংশ ছোট ছোট বরফখণ্ডে পরিণত হয়। এগুলো বেশি ভারী বলে উপরের দিকে উঠতে পারে না। বৃষ্টিধারার সাথে নিচে নেমে আসে। এটাই শিলাবৃষ্টি। এই বৃষ্টির প্রধান শর্তই হচ্ছে প্রচণ্ড গরম থাকতে হবে। আমাদের দেশে বৈশাখ মাসে প্রচণ্ড গরম পড়ে বলে কালবৈশাখী ঝড়ের সময় শিলাবৃষ্টি হয়।

শিলার আকার ছোট বড় কেন হয়?

সাধারণত ১৪ হাজার ফুটের নিচে যদি হিমাংক রেখা (যেখান থেকে বাতাসের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে নেমে যায়) থাকে এবং সেখানে বজ্রমেঘ তৈরি হয়, তাহলে শিলার আকার তুলনামূলকভাবে বড় থাকে। এগুলো কম দূরত্ব পেরিয়ে নিচে নেমে আসে। কিন্তু হিমাংক রেখা উপরে চলে গেলে শিলাবৃষ্টির স্থায়ীত্ব কমে আসে। ওই দূরত্ব অতিক্রম ভূপৃষ্ঠে আসতে আসতে শিলাখণ্ড গলতে থাকে।

সাধারণত ঘণ্টায় ১০৩ কিলোমিটার বেগের ঊর্ধ্বমুখী বাতাস একটি গলফ বলের সমান শিলার টুকরা ধরে রাখতে পারে। আবার ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে শিলার টুকরা বেসবল আকার পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে। প্রচণ্ড ঝড়ের মেঘে তৈরি হওয়া একেকটি শিলা আকারে ২৫ মিলিমিটার বা ১ ইঞ্চিরও বেশি হতে পারে। গবেষকরা আগে ধারণা করতেন শিলার টুকরা শুধু গোলাকার হয়। তবে সম্প্রতি এই ভুল ভেঙেছে তাদের। দেখা গেছে, রাগবি বলের মত উপরিভাগ সমতল হতে পারে শিলাখণ্ডের।

শিলাবৃষ্টি

আসলে শিল আকারে যত বড় হবে, এর বাইরের গড়ন তত এবড়োখেবড়ো হবে। এতে বাতাসের বাধা কাটিয়েও দ্রুত মাটিতে আঘাত করতে পারে একেকটি শিলের টুকরা। আর যত জোরে নিচে আছড়ে পড়বে, ক্ষয়ক্ষতি তত বেশি হবে। শিলাবৃষ্টি সাধারণত ১৫ মিনিটের বেশি হয় না।

শিল পড়ার সময় করণীয়

ঝড়ের সময় যখন শিলাবৃষ্টি হয়, তখন শিল কুড়ানোর জন্য বাইরে যাওয়া উচিত নয়। এ সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করতে পারেন-

১) খোলা আকাশের নিচে থাকা যাবে না। কংক্রিটের ছাউনির নিচে থাকতে পারলে বেশি ভালো হয়। কারণ টিনের চালও বড় আকৃতির শিলার আঘাতে ফুটো হয়ে যেতে পারে।

২) গাড়ি চালানো অবস্থায় শিলাবৃষ্টি হলে গাড়ি ধীরে চালানো উচিত। নিরাপদ কোনো স্থানে গাড়ি পার্ক করে রাখতে পারলে বেশি ভালো।

৩) বাসায় থাকলে বের না হওয়াই উত্তম।

৪) ঝুলন্ত বিদ্যুতের তার স্পর্শ করা যাবে না। কোনো তার ছিঁড়ে গেলে অবশ্যই বিদ্যুৎ কোম্পানিকে জানাতে হবে।

৫) পার্বত্য এলাকায় থাকাকালীন শিলাবৃষ্টির কবলে পড়লে কোনো গুহায় ঢোকা যাবে না। কারণ ভূমিধসের কারণে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

শিলাবৃষ্টি কেন হয়, কীভাবে এর আকার ছোট বড় হয় এবং এ সময় কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখবেন, তা নিয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে দিলাম। সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।

0 I like it
0 I don't like it