গরমে হিটস্ট্রোক কেন হয় এবং এ থেকে বাঁচার উপায় কী?

heatstroke

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সবাই হাঁসফাঁস করছে। ঘরে বাইরে কোথাও যেন একটুও আরাম নেই। যাদের ঘরে বা অফিসে এসি আছে, তারা কিছু সময় আরামে থাকলেও বাইরে বের হওয়ার সাথে সাথে তাপের কারণে মনে হয় যেন চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে হিটস্ট্রোক হওয়ার চান্সও বেড়ে যাচ্ছে। সব বয়সীরাই এই স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে কিছু নিয়ম মানতে হবে। গরমে হিটস্ট্রোক কেন হয় এবং এ থেকে বাঁচার উপায় কী সে সম্পর্কে কিছু পরামর্শ চলুন জেনে নেই।

হিটস্ট্রোক কী?

হিটস্ট্রোক এক ধরনের হাইপারথার্মিয়া। হাইপার হচ্ছে অধিক মাত্রা এবং থার্মিয়া মানে তাপ। শরীরে তাপমাত্রা অত্যাধিক বেড়ে গেলে তাকে বলা হয় হিটস্ট্রোক। নানা রাসায়নিক ক্রিয়ার কারণে আমাদের শরীরে তাপ সৃষ্টি হতে থাকে। ঘাম হলে সেই তাপ শরীর থেকে বের হয়ে যায়। আর শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যায় বলে দেখা দেয় ডিহাইড্রেশন। ঘামের সঙ্গে লবণও বের হয় বলে শরীরে দেখা দেয় লবণের ঘাটতি। এ কারণে শরীরে ক্লান্তি ভাব দেখা দেয়, কাজের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রির বেশি হয়ে গেলে মানুষের রক্তচাপ কমে যায়, এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। একে হিটস্ট্রোক বলে। যথাসময়ে এর চিকিৎসা না করলে রোগী মারাও যেতে পারেন।

গরমে হিটস্ট্রোক

আমাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস। তাপমাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন শরীরের রক্তনালী প্রসারণের মাধ্যমে অথবা ঘামের মাধ্যমে তাপ হারায় এবং ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘ সময় থাকলে অথবা অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে শরীর তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর এ কারণেই হিট স্ট্রোক হয়।

গরমে হিটস্ট্রোক হচ্ছে বুঝবেন কীভাবে?

এমনিতেই অতিরিক্ত গরম পড়লে শরীর ঘেমে পানি বের হয়ে যায় বলে দুর্বল লাগতে থাকে। হিটস্ট্রোক যে হতে পারে সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। কিছু লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে আপনার হিটস্ট্রোক হচ্ছে। যেমন-

  • মাথা ঝিমঝিম করা
  • মাসল ক্র্যাম্প
  • ঘন ঘন শ্বাস নেয়া
  • রক্তচাপ কমে যাওয়া
  • ঘাম বন্ধ হয়ে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
  • প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
  • অসংলগ্ন আচরণ ও কথাবার্তা বলা
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
  • খিঁচুনি হওয়া
  • বমি বমি লাগা বা বমি হওয়া
  • প্রেশার কমে যাওয়া
  • নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা
  • ডিহাইড্রেশন (মুখ শুকিয়ে যাওয়া ও পিপাসা পাওয়া)
  • আপনার নিজের বা আশেপাশের কারও শরীরে হাত দিয়ে যদি দেখা যায় যে তাপমাত্রা অনেক বেশি, কিন্তু শরীর ঘামছে না। এমন হলে যত দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।গরমে হিটস্ট্রোক হলে মাসল ক্র্যাম্প হতে পারে

হিটস্ট্রোক হলে তাৎক্ষণিক করণীয়

আপনার আশেপাশে যখনই কাউকে হিটস্ট্রোক করতে দেখবেন তখনই তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে যেতে কিছু কাজ তখনই করতে হবে।

১) হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ছায়াযুক্ত স্থানে বা বাতাস আছে এমন স্থানে নিয়ে বসান অথবা শুইয়ে দিন। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে হাতপাখা বা কাগজ দিয়ে বাতাস করুন।

২) ব্যক্তি যদি ভারী কাপড় পরে থাকে সেগুলো যতটা সম্ভব খুলে দিন। এতে তার শরীরে বাতাস প্রবেশ করবে।

৩) শরীরে পানি ছিটিয়ে দিন অথবা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দিন। এ সময় তাকে বাতাস করে যেতে হবে। বাতাসে শরীরের পানি শুকিয়ে আসলে চামড়া ঠান্ডা হয়ে আসবে। আশেপাশে বরফ পাওয়া গেলে কাপড়ে বরফ পেচিয়ে ঘাড়, পিঠ ও বগলের নিচে রাখলে শরীরের তাপমাত্রা কমে আসবে।

৪) রোগীকে পানি পান করানোর চেষ্টা করুন। পানি, ডাবের পানি বা ওরস্যালাইন এ সময় তাকে বিপদমুক্ত রাখবে।

এই কাজগুলো করার পর যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

হাসপাতালে না নিলে কী হতে পারে?

গরমে হিটস্ট্রোক হওয়ার পর যদি সময়মত হাসপাতালে না নেয়া হয় তাহলে বেশ কিছু সমস্যা হতে পারে। ধাপে ধাপে অর্গান ফেইল হওয়া শুরু করবে। প্রথমে ব্রেইনের নিউরনগুলো ড্যামেজ হবে। এরপর আমাদের লিভার ও রক্তনালীর সেলগুলোর ড্যামেজ শুরু হবে। ধীরে ধীরে সব অর্গানই ফেইল হতে থাকবে। রোগী যদি এই অবস্থায় পৌঁছে যায় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব আইসিইউ আছে এমন হাসপাতালে নিতে হবে।

এই আবহাওয়ায় সুরক্ষা পেতে করণীয়

১) জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বের না হওয়াই ভালো।

২) ঘরের বাইরে নরম সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। রোদে বের হলে এমন পোশাক বেছে নিন যাতে শরীর পুরোটা ঢেকে থাকে।

৩) বাইরে গেলে অবশ্যই ছাতা সাথে রাখুন। সুতি কাপড়ের স্কার্ফ বা ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রাখুন।

৪) পানির বোতল, রুমাল বা টিস্যু ব্যাগে রাখুন।

৫) চোখের সুরক্ষায় সানগ্লাস ব্যবহার করুন। ত্বকের সুরক্ষায় সানস্ক্রিন অবশ্যই লাগিয়ে নিন।

৬) যতটুকু সম্ভব ঠান্ডা তরল ও ডাবের পানি পান করুন।

৭) মাংস, তেলে ভাজা খাবার, ফাস্টফুড যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।

৮) কাশি হলে বা গলায় খুশ খুশ করলে মধু, লবণ ও আদার রস মিশিয়ে খেতে পারেন। সেই সাথে গরম পানি দিয়ে কুলকুচি করুন।

৯) ভিটামিন সি যুক্ত ফল নিয়মিত খান।

১০) মৌসুমি ফল যেমন তরমুজ, বাঙ্গি বেশি বেশি খান। এতে শরীর ঠান্ডা থাকবে। পানিশূন্যতা কমবে। কাঁচা আমও খেতে পারেন। কাঁচা আম শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।গরমে দরকারি জিনিস

যা যা খাবেন

গরমে হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে শুধু বাহিরে যাওয়ার আগে সতর্কতা নিলেই হবে না। খাবার তালিকাতেও আনতে হবে পরিবর্তন। কিছু খাবার খেতে হবে, কিছু বাদ দিতে হবে।

১) অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, মাংস, তেলে ভাজা খাবার, ফাস্টফুড যতটা সম্ভব কম খেতে হবে।

২) প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো খাবার খাওয়া যাবে না।

৩) কাঁচা পেঁপে, পটল, ধুন্দল, শসা, চিচিঙ্গা, গাজর, লাউ, পালংশাক, টমেটো ইত্যাদি অবশ্যই সবজির তালিকায় রাখবেন।

৪) চর্বি যুক্ত মাংসের বদলে ছোট বা মাঝারি সাইজের দেশি মুরগি বেছে নিন।

৫) নানা ধরনের শাক, সিদ্ধ ডিম, বুটের ডালের তরকারি খাদ্য তালিকায় রাখুন।

৬) চা কফি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। একদমই না পারলে রঙ চা পান করুন।

৭) আমে আছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, ভিটামিন সি ও ম্যাগনেসিয়াম। আম শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া তরমুজ, বাঙ্গিও এই গরমে শরীর ঠান্ডা রাখবে।

৮) আখের রস, বেলের শরবত, পুদিনার শরবত, জিরা পানি, লেবু পানি যতটা পারবেন পান করবেন। গরমে ঘাম হয় বলে শরীর থেকে পরিষ্কার পানি বের হয়ে যায়। এ সময় ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স তৈরি হয়। ব্যালান্স ঠিক রাখতে তাই এই পানীয়গুলো পান করা উচিত।

৯) খোসাসহ ফল, লেবু ও কাঁচা সালাদ খান।

১০) একবারে বেশি খাবার খাবেন না। গরমে একবারে অতিরিক্ত খাবার খেলে হাঁসফাঁস লাগতে পারে। সে জন্য অল্প অল্প করে বারবার খাবার খেতে হবে।ফলের জুস

আরও কিছু পরামর্শ
  • অপ্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকুন।
  • বাইরে না গেলে ঘরের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি করুন।
  • সকালে সূর্য ওঠার আগে ও সূর্য ডোবার পর হাঁটুন।
  • আরামদায়ক ও হালকা রঙের পোশাক পরুন।
  • বাহির থেকে আসার সাথে সাথেই প্রচণ্ড ঠান্ডা পানি, কোল্ড ড্রিংকস বা ঠান্ডা পানির শরবত পান করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ এতে ঠান্ডার সমস্যা হতে পারে।

গরমে হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচার জন্য সবাই কিছু না কিছু করছি। তবে সেই করাটা হতে হবে ফলপ্রসূ। নইলে শরীর ভালো না হয়ে খারাপ হতে বেশি সময় লাগবে না। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

ছবি – সাটারস্টক

2 I like it
0 I don't like it