ওয়ার্কপ্লেসে নারীদের হ্যারাজমেন্ট বন্ধ করতে কি করা যেতে পারে?

ওয়ার্কপ্লেসে নারীদের হ্যারাজমেন্ট বন্ধ করতে কি করা যেতে পারে?

গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার পরপরই ড্রিম জবটা পেয়ে যায় নুজহাত। দারুণ অ্যাকাডেমিক রেকর্ডস, তার ওপর বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজে পারটিসিপেট করায় একটা স্বনামধন্য কর্পোরেট কোম্পানিতে জব পেতে তার মোটেও অসুবিধা হয়নি। নুজহাত তার জব লাইফের শুরু থেকেই চেষ্টা করে গেছে যেন তার পারফরম্যান্স ভালো থাকে। সেকারণে  বেশ তাড়াতাড়িই তার প্রোমোশন হয়। প্রোমোশন পাওয়ার পরেরদিন সে যখন অফিসে গেলো, তখন তার কলিগ মিস্টার আফসার বলে বসলেন, “কি নুজহাত, বসের রুমে রেগুলারলি গিয়েই কি প্রোমোশনটা পেলেন নাকি?” এ কথা শোনার পর নুজহাতের সব এক্সাইটমেন্ট রূপ নিলো চোখের পানিতে। তার শুধু একটা কথাই মনে হতে লাগলো, “আচ্ছা, মেয়েরা কি সারাজীবন সবখানে শুধু হ্যারাজডই হয়ে যাবে?”

এই গল্পটা শুধু নুজহাতের নয়, বরং এমন হাজারো নুজহাত প্রতিনিয়তই তাদের ওয়ার্কপ্লেসে হ্যারাজমেন্টের স্বীকার হচ্ছেন।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের নারীরা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে চলেছেন বারবার। কিন্তু একইসাথে এটাও সত্যি যে যুগে নারী পুরুষের সমতা নিয়ে এত আলোচনা হয়, সে যুগে নিজেদের ওয়ার্কপ্লেসেই নারীদের স্বীকার হতে হয় পুরুষ কলিগদের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের কিংবা ব্যুলিংয়ের।

ওয়ার্কপ্লেসে নারীদের হ্যারাজমেন্টের প্রধান কারণ হলো বেশিরভাগ কোম্পানি সবসময় চেষ্টা করে এ ধরণের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়ার। তারা এই হ্যারাজমেন্টের ইস্যুগুলো নিয়ে নারীরা যেন প্রতিবাদ না করে সেটা নিশ্চিত করে নারীদের অপমান করে কিংবা চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে। এর পাশাপাশি দেশে সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ না হওয়াও এই হ্যারেজমেন্ট এত বেড়ে যাওয়ার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

চলুন এবার দেখার চেষ্টা করি পরিবার ও সমাজ এই হ্যারাজমেন্টের বিষয়গুলো কিভাবে দেখে৷ যখন একজন নারী তার ওয়ার্কপ্লেসে হ্যারাজড হন, তখন তিনি মানসিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েন। এসময় পরিবারের সাপোর্ট তো দূরে থাক, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে তাদেরকেই ব্লেইম করা হয় এবং লোকলজ্জার ভয়ে চুপ করে থাকতে বলা হয়। পাশাপাশি আমাদের সোসাইটিতে এই আধুনিক যুগে এসেও নারীরা হ্যারাজড হলে সেটার জন্য তাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাদেরকে এটার সাথে মানিয়ে নিতে ফোর্স করা হয়। তখন নারীরা প্রতিবাদ করার মানসিক শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেন।

আবার কোনো নারী যদি হ্যারাজড হওয়ার পর সাহস করে পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে চান, তখন মামলা করার সময়ও তাদের বিভিন্ন হ্যাসেল পোহাতে হয়। যেমনঃ পুলিশের জাজমেন্টাল কমেন্টস, একের পর এক প্রশ্ন কিংবা কথা দিয়ে নারীদের আনকমফোর্টেবল ফিল করানো – ইত্যাদি তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আবার মামলা করা হলে সেখান থেকে ন্যায় বিচার পাওয়াও সময়সাপেক্ষ। তাই বলা যেতে পারে ওয়ার্কপ্লেসে নারীরা হ্যারাজড হলে তারা কোথাও থেকেই সেভাবে সহযোগিতা বা সাপোর্ট পাননা।

এবার একটু স্ট্যাটিসটিকস শেয়ার করি। কর্মজীবী নারী ও কেয়ার বাংলাদেশের যৌথ গবেষণার একটা রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে ১২.৭০ পারসেন্ট নারীরা তাদের ওয়ার্কপ্লেসে হ্যারাজমেন্টের স্বীকার হন। নিশ্চিতভাবেই এ পারসেন্টেজ অনেক বেশি। কারণ ,বেশিরভাগ নারী লজ্জায়, জব হারানোর ভয়ে কিংবা নিজের ইমেজের ক্ষতি হবে সে আশংকায় এ ইস্যু নিয়ে কথা বলেননা।

নারীরা যখন ওয়ার্কপ্লেসে ফিজিক্যালি কিংবা মেন্টালি  হ্যারাজড হন, তখন এটার প্রভাব পড়ে তাদের মেন্টাল হেলথের ওপর। তারা তখন বিভিন্ন সমস্যা ফেইস করতে থাকেন যেমনঃ প্যানিক অ্যাটাক, ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, রাতে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখা, সুইসাইডাল থটস ইত্যাদি। আশা করি বুঝতে পারছেন যে এই ইস্যুটা একজন নারীর ওপর কতটা বাজেভাবে ইমপ্যাক্ট ফেলে!

ওয়ার্কপ্লেসে হ্যারাজমেন্ট বন্ধ করতে কী কী স্টেপ নেয়া উচিৎ?
ফিমেল ফ্রেন্ডলি ওয়ার্কপ্লেস ক্রিয়েট করা নারীদের হ্যারাজমেন্ট বন্ধ করার অন্যতম প্রধান উপায়। প্রতিটা কোম্পানির পলিসিতেই নারীদের যারা হ্যারাজ করবে, তাদের প্রতি জিরো টলারেন্স শো করার বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে ধীরে ধীরে হ্যারাজমেন্টের কেইস কমে আসা শুরু হবে।

নারীরা যদি হ্যারাজড হন, তাহলে যেন নির্দ্বিধায় কমপ্লেইন করতে পারেন, সেটার জন্য অফিসে একটা কমপ্লেইন বক্স ক্রিয়েট করা যেতে পারে। তবে কমপ্লেইন বক্স ক্রিয়েট করলেই কিন্তু দায়িত্ব শেষ নয়, বরং কোম্পানির অথোরিটির দায়িত্ব হলো তাদের কাছে আসা প্রতিটা কমপ্লেইন সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া এবং যারা হ্যারাজ করেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা।

একইসাথে দেশের আইনকানুনও স্ট্রিক্ট হতে হবে, যাতে করে নারীদের হ্যারাজ করার আগে মানুষ অন্তত ১০ বার ভাবে। এর পাশাপাশি হ্যারাজমেন্টের কেইসগুলো যেন যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করে নারীদের জাস্টিস দেয়া যায়, সে বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।

সর্বোপরি নারীদের সাহসী হতে হবে। ওয়ার্কপ্লেসে হ্যারাজড হলে চুপ করে থাকা যাবেনা, বরং সাথে সাথে প্রতিবাদ করতে হবে। কেননা একজনের প্রতিবাদ দেখে আরো দশজন প্রতিবাদ করতে অনুপ্রাণিত হন। আর এ প্রতিবাদই পারে ওয়ার্কপ্লেসে নারীদের হ্যারাজমেন্ট কমিয়ে ফেলতে।

0 I like it
0 I don't like it

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.