স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতন হোন আজই!

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতন হোন আজই!

কিছুদিন ধরে বেশ চিন্তায় আছে নুসরাত। তার ডান স্তনে কেমন যেন চাকার মতো কিছু অনুভূত হচ্ছে, সাথে আবার ব্যথাও আছে। সে কাকে বলবে লজ্জায় বুঝতে পারছেনা। তারপর এক বান্ধবীর সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ম্যামোগ্রাম করার পর নুসরাতের স্তন ক্যান্সার ধরা পড়লো।

স্তন ক্যান্সার একটি ঘাতক ব্যাধির নাম। সঠিক সময়ে এ ক্যান্সার শনাক্ত করা না গেলে পরবর্তীতে এটি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মূলত নারীরাই স্তন ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হলেও পুরুষদেরও এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ ডাটা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৩ হাজারেরও বেশি নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যান। বাংলাদেশ ক্যান্সার এইড ট্রাস্ট নামক সংগঠনের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা যে ক্যান্সারে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হন সেটি হলো স্তন ক্যান্সার।

তবে বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সার নিয়ে নারীদের সচেতন করতে সেভাবে কোনো ক্যাম্পেইনই দেখা যায়না। যদিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে অনেকেই এই ইস্যুটি নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু যাদের কাছে ইন্টারনেটের অ্যাকসেস নেই কিংবা যারা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীতে অবস্থান করেন, তারা স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সেভাবে জানেননা।

আবার এই বিষয়টি এখনও আমাদের সমাজে ট্যাবুর মতো। তাই সেভাবে কেউ খোলাখুলি কথা বলতে চাননা। কিন্তু এমনটি করলে চলবেনা। যেহেতু এই ক্যান্সার মৃত্যুঝুঁকির কারণ এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব, তাই স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে প্রতিটি নারীকে অবশ্যই জানতে হবে।

স্তন ক্যান্সার কী?
চলুন শুরুতেই জেনে নেয়া যাক স্তন ক্যান্সার কী। স্তন ক্যান্সার তখনই হয় যখন স্তনে থাকা কোষের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করে। এ কোষগুলো এক পর্যায়ে টিউমারে রূপান্তরিত হয়। জেনে রাখা ভালো, এ টিউমারের ধরণ দুটি। যদি স্তনে বিনাইন টিউমার হয়, তাহলে সেটি দেহের অন্য কোনো অংশকে আক্রান্ত করেনা। তবে টিউমারটি ম্যালিগনেন্ট হলে তা দেহের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

কাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি?
সাধারণত যাদের বংশে পূর্বে কেউ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের এটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচাইতে বেশি থাকে। এছাড়াও যারা ঝুঁকিতে থাকেন তারা হলেন-

  • যাদের বয়স ৪০ এর বেশি।
  • যারা নিঃসন্তান অথবা সন্তান থাকলেও যারা ব্রেস্টফিড করাননি।
  • যারা দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিরোধক বড়ি সেবন করছেন।
  • যেসব নারীর ১২ বছর বয়স হওয়ার আগে মাসিক শুরু হয় এবং ৫০ বছর বয়স হওয়ার পর মেনোপজ অর্থাৎ মাসিক বন্ধ হয়।
  • যাদের অতিরিক্ত ওজন এবং একইসাথে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেন।
  • যাদের ধুমপান কিংবা অন্যান্য নেশা করার অভ্যাস রয়েছে।

স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ কী কী?
স্তন ক্যান্সারের প্রধান কয়েকটি লক্ষণ হলো।

  • স্তনে চাকা অনুভূত হওয়া।
  • স্তনের চামড়া কিংবা রংয়ে হঠাৎ পরিবর্তন নজরে আসা।
  • স্তনে ব্যথা হওয়া।
  • স্তনের নিপল থেকে ব্লিডিং কিংবা রস বের হওয়া।
  • নিপল ভেতরের দিকে ঢুকে যেতে থাকা।
  • অসমান নিপল।
  • বগলের নিচে চাকা চাকা অনুভূত হওয়া।

এ লক্ষণ দেখা দিলে কী করবেন?
কারো এই লক্ষণগুলোর মধ্যে যদি কোনো একটি দেখা দেয়, তাহলে অতিসত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যদি দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে প্রাথমিক অবস্থাতেই স্তন ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব। স্তন ক্যান্সার হয়েছে কিনা সেটি বোঝার জন্য সাধারণত মেমোগ্রাম করার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। মেমোগ্রামকে স্তনের এক্সরেও বলা হয় এবং এই স্পেশাল এক্সরের সাহায্যে একজন চিকিৎসক কোনো নারীর স্তন ক্যান্সার হয়েছে কিনা তা বুঝতে পারেন।

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে নিজেই স্তন পরীক্ষা করুন
একজন নারীর ২০ বছর বয়স হওয়ার পর থেকে চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন নিয়মিতভাবে নিজের স্তন পরীক্ষা করার, যাতে স্তনে কোনোপ্রকার অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে তা শুরুতেই নির্ণয় করা যায়। প্রতিমাসে মাসিক শেষ হওয়ার পরের এক সপ্তাহ এ পরীক্ষাটি করার জন্য আদর্শ সময়।

এ পরীক্ষাটি করার জন্য পর্যাপ্ত আলো রয়েছে এমন একটি স্থান বেছে নিন। শুরুতে দুই হাত দু’পাশে সাধারণভাবে ঝুলিয়ে রেখে আয়নার সামনে দাঁড়ান। অবশ্যই সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। দাঁড়ানোর পর দুটি স্তনের দিকে লক্ষ্য করে বোঝার চেষ্টা করুন স্তনের আকার, আকৃতি, রং এবং নিপলে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নজরে আসছে কিনা। বিশেষ করে স্তনের কোনো অংশ ফোলা মনে হচ্ছে কিনা, নিপল ভেতরের দিকে ঢুকে যাচ্ছে কিনা অথবা নিপল থেকে রক্ত বা রস নির্গত হচ্ছে কিনা তা খেয়াল করুন। তারপর নিজের দু’হাত ওপরে তুলে, কোমরের দু’পাশে চাপ দিয়ে রেখে আবার লক্ষ্য করুন ও স্তনের অবস্থা স্বাভাবিক কিনা তা নির্ণয় করুন৷

এরপর হলো স্তন পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপ। এটির জন্য বিছানায় বা কোনো সমতল স্থানে শুয়ে পড়ুন৷ যদি শুরুতে ডান স্তন পরীক্ষা করতে চান, তাহলে ডান কাঁধের নিচে অবশ্যই একটি বালিশ দিয়ে নিন। তারপর বাম হাতের তিনটি আংগুলের সাহায্যে পর্যায়ক্রমে হালকা থেকে ভারী চাপ প্রয়োগ করে পুরো স্তন পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে কোথাও কোনো চাকা রয়েছে কিনা। একইভাবে বাম স্তনের ক্ষেত্রেও একই কাজ করুন। এই পরীক্ষাটি গোসলের সময় দাঁড়িয়ে শরীরে সাবান মাখার পর একই পদ্ধতিতে করতে হবে৷

এভাবেই আপনারা বাড়িতে নিজের স্তন নিজেই পরীক্ষা করতে পারবেন। মনে রাখবেন, স্তন ক্যান্সার নিয়ে কথা বলা কোনো ট্যাবু নয়৷ তাই লজ্জা ভুলে নিজে সচেতন হয়ে বাকিদেরও সচেতন করুন৷

0 I like it
0 I don't like it

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.